বার্সেলোনার ২১, দেশের ৩৬

বিশ্ব বাংলা ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৩৮:৪৯,অপরাহ্ন ০৬ আগস্ট ২০২৫২০২৪ সালের জুলাই মাসটা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আলাদা ছিল। ঢাকার উত্তপ্ত রাজপথ থেকে বাংলাদেশের সব জায়গা যেন এক হয়ে গিয়েছিল একটিই নামে ‘আন্দোলন’। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্রদের এক অরাজনৈতিক উদ্যোগ ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছিল এক সর্বজনীন গণআন্দোলনে।
সেই ঢেউ এসে পৌঁছেছিল হাজার মাইল দূরের বার্সেলোনায়ও। আমি তখন প্রতিদিনের মতো বসে ছিলাম ডট মিডিয়া’য়, হাতে এক কাপ করতাদো আর কিছু ঘনিষ্টজন। আলোচনা হচ্ছিল দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কিন্তু সেই আলোচনা যেন ক্রমে পরিণত হচ্ছিল দায়বদ্ধতায়, চিন্তা ছিল পাশে দাঁড়ানোর। মনে হচ্ছিল শুধু কথা বলে হবে না, এই নীরবতার দায় আমরা এড়াতে পারি না। এই কথাগুলো চলার ফাকেই আমার এক ভাগনা ফোন দিয়ে বললো ‘মামা, কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থী ছোট একটা বিক্ষোভ করতে চায়। আপনি যদি একটু সহযোগিতা করতেন…’
একটি ছোট অনুরোধ, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার কাছে মনে হয়েছিল এক বিশাল দায়িত্ব। আগের যত ভাবনা, যত জড়তা সব ঝেড়ে ফেলে আমি সেদিনই বার্সেলোনা সিটি কাউন্সিলের পারমিট নিলাম, ইনস্যুরেন্স করলাম, ফোন করলাম একে একে পরিচিত অপরিচিত সবাইকে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনবক্স, কল, যার মাধ্যমে সম্ভব বার্তা ছড়িয়ে দিলাম ২১ জুলাই, বিকাল ৭টা, প্লাসা উনিভার্সিটাদে বিক্ষুভ সমাবেশের।
১৯ জুলাই এই দিনেই প্রথম যোগাযোগ হল এ.বি.এম. মাজহারুলের সাথে। এরপর এলেন হামিদ রুহেল, ফয়সল মোল্লা। আমরা পাঁচজন হয়ে উঠলাম সেই আন্দোলনের প্রাথমিক চালিকাশক্তি। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই একে একে যুক্ত হতে শুরু করলেন আরও অনেকে, নুরুল ওয়াহিদ, সাহাদুল সুহেদ, লোকমান হোসেন, লায়েবুর রহমান, মোবিন খানসহ অনেক সাংবাদিক, কমিউনিটি সংগঠক, ছাত্র যুবক ও পেশাজীবী। বার্সেলোনার বাতাস যেন ধীরে ধীরে ঘন হয়ে উঠছিল প্রতিবাদের গন্ধে, প্রতিরোধের ছায়ায়। শহরের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে পড়ছিল এক অনিবার্য জেগে ওঠার প্রস্তুতি।
উদ্যোগ নেয়ার সাহস ছিল, কিন্তু তার আগে পার হতে হয়েছিল ভয়ের দেয়াল। হুমকি এসেছিল আমাদেরই দূতাবাস থেকে, তালিকা করা হচ্ছে, নজরে রাখা হচ্ছে, দেশে বাড়িতে বাড়িতে প্রশাসনের উপস্থিতি।
ভয়ের চাদর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল যেন কেউ উঠে না দাঁড়ায়। আমরা জানতাম যে লড়াই স্বপ্ন থেকে জন্ম নেয়, তাকে থামানো যায় না ভয়ের কুয়াশায়। প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালো, আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। অবশেষে এলো সেই দিন ২১ জুলাই ২০২৪। বার্সেলোনার প্লাসা উনিভার্সিটাদ মুখর হয়ে উঠলো হাজারো বাংলাদেশির পদচারণায়। ছাত্রদের ব্যানারে (এক্স বাংলাদেশি স্টুডেন্টস, বার্সেলোনা) আয়োজন হলেও এই বিক্ষোভ হয়ে উঠলো এক সর্বজনীন প্রতিরোধের মঞ্চ।
বার্সেলোনায় আয়োজিত স্বৈরাচার সরকার পতনের ঐতিহাসিক মিছিলে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মুসলিম কমিউনিটি, খেলাফত মজলিসসহ প্রবাসে সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাদের ঐক্যবদ্ধ উপস্থিতি ও সংগঠিত প্রচেষ্টায় আন্দোলনের ভিত্তি আরও মজবুত হয়। তাদের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন, মিডিয়াকর্মী এবং নারীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, গড়ে ওঠে এক ব্যতিক্রমী জাতীয় সংহতি। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যানার ছাড়াও কারও কাছে ছিল নিজ হাতে বানানো প্ল্যাকার্ড, কেউ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন লাল সবুজের পতাকা। স্লোগান ছিল অগ্নিঝরা, সরকার পতনের দৃপ্ত প্রত্যয়ে মুখর হয়ে ওঠে প্লাসা উনিভার্সিটাদ।
মাত্র দুই ঘণ্টার সমাবেশটি শুধু প্রতিবাদের ছিল না, ছিল ভালোবাসা, কান্না, আশ্রয়, আশা আর দেশের প্রতি নিঃশর্ত দায়বদ্ধতার এক প্রকাশ। কেউ কেউ চোখ মুছছিল, কেউ গলা ভেঙে চিৎকার করছিল, আবার কেউ দাঁড়িয়ে ছিল নীরবে হাত মুঠো করে।
দেশ তখন যে আগুনে, প্রবাস তখন শিরায় শিরায় জ্বলছিল সেই একই আগুনে। রাত নামার আগে আমরা দেখলাম প্রায় ৫ হাজার অধিক মানুষের মিছিল। অনেকেই অনেককে চিনেন না তবুও যেন সবাই একই হৃদয়ের স্পন্দনে হাঁটছে। সেদিন বার্সেলোনায় কোনো বিভক্তি ছিল না, ছিল না দল মত বা পরিচয়ের দেয়াল। ছিল শুধু একটি পরিচয় ‘আমরা বাংলাদেশি’।
তাৎপর্যপূর্ণ সেই প্রতিবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ বিদেশের গণমাধ্যমে। সেদিন আমরা সবাই বিশ্বাস করেছিলাম, এক অলৌকিক তারিখ পাবোই, হয়তো তা পঞ্জিকায় নেই কিন্তু আছে স্বপ্নে, আছে আশায়, আছে আন্দোলনের প্রতিটি ফিসফাসে।
পেয়েছি ইতিহাস, পেয়েছি মুক্তির প্রতীক, প্রতিরোধের গন্তব্য ‘৩৬ জুলাই’।
আফাজ জনি
বার্সেলোনা, ০৬ আগস্ট ২০২৫ইং।
