ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দায় নজিরবিহীন সংকটে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা
মিরন নাজমুল
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:০৭:৫৪,অপরাহ্ন ২৮ জুলাই ২০২০করোনা মহামারীর কারণে ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে ইউরোপের প্রবাসী বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা। বেশি সংকটের শিকার হয়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসায়ী। বিশেষ করে ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রিসের বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন।
এইসব দেশগুলোতে অনেক বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে লোকসানের মুখে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
সারা ইউরোপে প্রায় অর্ধেকের বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরণের ব্যবসায়ীদের লোকসান গুণতে গুণতে বর্তমানে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ইউরোপের অন্যান্য বাংলাদেশী অধ্যুষিত দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, বেলজিয়ামের বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরাও কিছু কিছু শহরে ব্যবসায়ীক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
বিশেষ করে পর্যটন নির্ভর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কভিড১৯ মহামারী শুরুর পর থেকে ৪ মাস একটানা লোকশান গুনে অনেকে মূলধন হারিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
অনেক বাংলাদেশী ব্যবসায়ী করোনা মহামারীর চরম সংক্রমনকালীন সময়ে ২ মাস ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছে। মহামারি সঙ্কট প্রাথমিকভাবে কেটে যাবার পরও আগের স্বাভাবিক অবস্থা না ফেরার কারণে, বর্তমানে নিজেদের জমানো টাকা খরচ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। বাকী পড়ে যাচ্ছে মোটা অংকের দোকানভাড়াসহ সরকারের ট্যাক্স ও কর্মচারীর বেতন।
বড় ধরণের লোকশান গুণেও বর্তমান সময় পর্যন্ত যারা টিকে আছে, তারা ভবিষ্যত অন্ধকার দেখছে। ব্যবসার ভরা মৌসুমে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) ইউরোপের বিখ্যাত শহরগুলো পর্যটনশূন্য এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতাবিহীন।
ইউরোপের বিভিন্ন বড় শহরে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, করোনা মহামারীর সংক্রমনের কারণে প্রায় কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই লকডাউনের কারণে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে তাদের। কিন্তু পুনরায় খোলার পরেও অনেক ব্যবসায়ীদের বিক্রি পড়ে গেছে শতকরা ৭০ থেকে ৯০ ভাগ।
বর্তমানের বিক্রি দিয়ে ব্যবসার আনুষাঙ্গিক খরচের এক তৃতীয়াংশও পুরণ হবে না বলে জানিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। তবে লক ডাউনের কারণে অনেক শহরে মানুষ গৃহবন্ধী হয়ে পড়ার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের দোকান (আলিমেন্টারি), ফলের দোকানসহ তৈরি খাবার হোমডেলিভারীর সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ভালো হয়েছে বলেও জানা গেছে। তবে, বর্তমানে সারা ইউরোপ জুড়ে চলা অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়া নিয়ে সঙ্কায় আছেন।
ইতালি:
ইতালিতে ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি সময় থেকে করোনা সংক্রমন তীব্র আকার ধারণ করলে ইতালিতে বসবাস করা প্রায় দেড় লক্ষাধীক বাংলাদেশিরাও সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে পড়েন। চাকুরীজীবীদের জন্যে সরকারি প্রনোদনার ব্যবস্থা থাকলেও ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারি সহযোগিতা অপ্রতুল থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা সঙ্কটে পড়েন।
ইতালির রোম, ভ্যানিস, ফ্লোরেন্স শহর বর্তমানে পর্যটনশূণ্য হওয়ার কারণে,পর্যটন নির্ভর বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের অনেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে এবং অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেবার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, ইতালিতে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ব্যবসার সাথে জড়িত এছাড়া সাইবার ক্যাফে, মোবাইল ফোনের দোকান, মানি ট্রান্সফার, ভ্রাম্যমান তৈরি পোশাকের দোকান এমন ধরণের ব্যবসার সাথে জড়িত।
স্পেনে করোনা মহামারীর তীব্রতা শুরু হলে মার্চের মাঝামাঝিতে জরুরী রাষ্ট্রীয় সতর্কতা জারি করা হয়। এ সময় প্রয়োজনীয় খাদ্যের দোকান (আলিমেন্টারি) ও ফলের দোকান ছাড়া কফিসপ, রেস্টুরেন্ট, মানি ট্রান্সফারসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ করে বন্ধ করে দিতে হয়।
স্পেন:
স্পেনে প্রায় ৪৫ হাজার বাংলাদেশীদের মধ্যে প্রায় ৯৫ভাগ রাজধানী মাদ্রিদ ও বার্সেলোনায় বসবাস করে। এই দু’টো শহরই পর্যটন নির্ভর হওয়ায় বাংলাদেশীদের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী পর্যটন নির্ভর। এ জন্য ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশী ব্যবসায়ীর সংখ্যাও অনেক বেশি। ব্যবসায় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশী ব্যবসায়ী রেজাউল করিম জানায়, গত ৩ মাসে সে ২ লক্ষ ইউরো শিকার হয়েছে এবং এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে তার ৫টা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩টা বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
তবে মাদ্রিদের আলিমেন্টারি ও ফলের ব্যবসায়ী সাইফুল আমিন জানান, মানুষ গৃহবন্ধী হয়ে যাবার কারণে লকডাউনের সময়ে তার দোকানে বিক্রি বেড়ে গিয়েছিলো। আগের তূলনায় প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ ব্যবসা হয়েছে তার। তবে বর্তমানে আবার ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। স্পেনে বাংলাদেশীরা আলিমেন্টারি (নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার সামগ্রির দোকান), রেস্টুরেন্ট, ফলের দোকান, মানিট্রান্সফার, মনোহরি দোকান, অ্যাপার্টমেন্ট (অল্প সংখ্যক) ব্যবসার সাথে জড়িত।
পর্তুগাল:
পর্তুগালে প্রায় ১৭ হাজারের অধিক বাংলাদেশীদের মধ্যে যারা ব্যবসায় জড়িত তাদের বেশিরভাগই পর্যটন নির্ভর ব্যবসার সাথে জড়িত। স্পেনের মতো প্রায় একই সময়ে (মার্চ মাস থেকে) করোনা মহামারির প্রদুর্ভাব শুরু হলে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় ধ্বস নামে। রাজধানী লিসবন, পর্তু, আলগ্রাম শহরে বাংলাদেশীরা পর্যটন নির্ভর স্যুভেনিরস (মনোহরি দোকান) ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া বাংলাদেশীদের আলিমেন্টারি ব্যবসায়ও দেখা দেয় চরম মন্দা।
বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও একাধীক ব্যবসায়ী জানিয়েছে, নতুন নিয়মে সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়। এছাড়া ব্যবসায় চরম মন্দার কারণে তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে মুলধন হারানোর ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।
গ্রিস:
গ্রিসের অ্যাথেন্সে বাস করেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রনি। তিনি জানান, প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশী গ্রিসে বসবাস করে। এদের মধ্যে বড় অংশ ব্যবসার সাথে জড়িত। তিনি জানান, বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের মধ্যেও মূলত যারা পর্যটন নির্ভর তারা ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে আলিমেন্টারি (নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবারের দোকান) থেকে লক ডাউনের কারণে অনলাইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রির অর্ডার হোম ডেলিভারি দিয়েছেন, তাদের ব্যবসা দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছিলো মহামারীকালীন সময়ে। এছাড়া গ্রিস সরকার সরকার চীন থেকে মাস্ক ও পিপিআই কেনা বন্ধ করে দেবার কারণে অনেক বাংলাদেশী গার্মেন্টস ব্যবসায়ী সে সুযোগে মাস্ক ও পিপিআই এর যোগান দিয়ে ব্যবসায় লাভবান হয়েছে।
ফ্রান্স:
একই সময়ে ফ্রান্স করোনা মহামারীর শিকার হলে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা প্রাথমিক অবস্থায় অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হন। বর্তমানে পর্যটন শিল্পের জন্য বিখ্যাত শহর প্যারিসসহ অন্য পর্যটন নির্ভর শহরে বাংলাদেশীদের ব্যবসায় আশঙ্কাজনকহারে মন্দা চলছে। প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশী বসবাসকারী ফ্রান্সে বাংলাদেশীদের মূল ব্যবসা মোবাইল ও মোবাইল অ্যাকসেসরি, আলিমেন্টারি, ফলের দোকান ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যেই ফরাসি সরকার ঘোষণা করেছে যে, ছোট বড় কোন ব্যবসায়ীকেই ফরাসি সরকার হুমকির মুখে পড়তে দেবে না। ইউরোপের চরম অর্থনৈতিক এই মন্দার সময়ে ফরাসি সরকারের এই ঘোষণায়, সেখানকার বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা আশ্বাস খুঁজে পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ফ্রান্সের বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা।