সিলেট অঞ্চলে মানবপাচারের ‘ধান্ধা’ বিশ্বনাথের পিংকির
ওয়েছ খছরু:
প্রকাশিত হয়েছে : ১:৩২:৪৩,অপরাহ্ন ০৩ অক্টোবর ২০১৯ভাই পারভেজ লিবিয়ায়। ওখান থেকে দিতো নির্দেশনা। দেশে বোন পিংকি। ভাইয়ের কাছ থেকে সব নির্দেশনা নিয়ে মানবপাচারের ধান্ধা শুরু করে। সিলেটের বিশ্বনাথের নিজ বাড়িতে বসেই গোটা সিলেট অঞ্চলে মানবপাচারের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। নিজেও খুবই চালাক। নিজেই ছুটে যেতেন পার্টির বাড়িতে। মনভুলানো কথা বলে ফাঁদে ফেলতেন মানুষকে।
তার কথায় বিগলিত হয়ে বিশ্বনাথসহ সিলেট অঞ্চলের অনেক যুবকই ইতালির পথে অজানার উদ্দেশ্য পাড়ি জমায়। শেষে লাশ হয়ে ফিরেন অনেকেই। গত মে মাসে ভূমধ্যসাগর ট্র্যাজেডির পর আর রক্ষা হয়নি বিশ্বনাথের পিংকির। মানবপাচারের ঘটনায় একাধিক মামলার আসামি হয় সে। বিষয়টি বুঝতে পেরে পিতা রফিককে নিয়ে বাড়ি থেকে পালায় পিংকি। প্রায় দুই মাস আগে ফিরে সিলেটে। আদালত থেকে নেয় জামিনও। এরপর সে বিশ্বনাথের কাটালীপাড়া গ্রামের বাড়িতেই অবস্থান করছিলো। সেই পিংকিকে গত রোববার রাতে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। আর গ্রেপ্তারের পর তাকে ঢাকার সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
ভূমধ্যসাগর ট্র্যাজেডির ঘটনার বিষয়টি তদন্ত করছে সিআইডি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে নেয়া হয়েছে বলে জানায় সূত্র। পিংকির পুরো নাম পিংকি অনন্যা প্রিয়া। বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বৈরাগীবাজার কাঠালীপাড়া গ্রামে। পিতা রফিকুল ইসলাম রফিক। পিংকির পুরো পরিবারই জড়িত মানবপাচারে। আর বিষয়টি তদারকি করে লিবিয়ায় থাকা ভাই পারভেজ আহমদ। কয়েক বছর আগে রফিক তার সন্তানদের নিয়ে বিশ্বনাথের পুরান বাজারের ভাড়া বাসায় থাকতো। ওই সময় পিংকির বিয়ে হয়েছিলো। পরবর্তীতে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার কারণে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়।
এরপর থেকে পিংকি পিতার পরিবারেই বসবাস করছে। পিংকি ও তার পরিবারের প্রতারণার শিকার হওয়া ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, কয়েক বছর ধরেই পিংকির পিতা রফিক আহমদ রফিক এলাকার লোকজনের মাধ্যমে কথা বলে তাদের সন্তানকে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিতে থাকে। এবং কম টাকায় ইতালি যাওয়ার পথ দেখায় সে। তার এই পরামর্শে কয়েকজন যুবক লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। এরপর রফিকের মাধ্যমে পরবর্তী কথাবার্তা বলার জন্য পাঠায় মেয়ে পিংকির কাছে। বিশ্বনাথের গ্রামের বাড়িতে বসেই পিংকি কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় কয়েকজন যুবক ইতালি যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে। এর মধ্যে ছিল বিশ্বনাথের নওধার মাঝপাড়া গ্রামের রেদওয়ানুল ইসলাম খোকন। ১১ই মে ভূমধ্যসাগর ট্র্যাজেডির ঘটনায় খোকন সাগরে মারা গেছে। এ ঘটনায় খোকনের ভাই রেজাউল ইসলাম রাজু বাদী হয়ে সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় মামলা করেছেন। মামলায় তিনি পিংকিকে আসামি করেছেন।
এ ছাড়া মামলায় পিংকির পিতা রফিকুল ইসলাম রফিক, সিলেটের রাজা ম্যানশনের ট্র্যাভেলস ব্যবসায়ী এনামুল হক, আব্দুর রাজ্জাক ও পিংকির লিবিয়া থাকা ভাই পারভেজকে আসামি করা হয়। এ মামলা দায়েরের আগেই এলাকা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো। প্রায় দুই মাস আগে সিলেটে ফিরে পিংকি। জামিন নিয়ে বিশ্বনাথে ফিরে। গতকাল র্যাব-৯ এর পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে রোববার সন্ধ্যায় অভিযানে সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানাধীন দক্ষিণ কাটালীপাড়া থেকে বানিয়াচং থানার মানবপাচার প্রতিরোধ, দমন আইনে দায়ের করা আসামি ও পাচারকারী নারী আসামি পিংকিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। তাকে ঢাকায় সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
পিংকির বিরুদ্ধে বিশ্বনাথ থানায় মামলা দায়েরকারী রেজাউল ইসলাম রাজু গতকাল জানিয়েছেন, পিংকি আপাদমস্তক একজন মানবপাচারকারী। পিংকিদের এলাকায়ই তার বাড়ি। পিংকির কথায় উৎসাহিত হয়ে ভাই খোকনকে ইতালি পাঠাতে রাজি হন। কিন্তু তার ভাই সাগরে মারা যায়। এতে পিংকির পরিবারকে প্রায় ৮ লাখ টাকা তারা দেন। তিনি জানান, পিংকির পিতা মাদকাসক্ত। এ কারণে মানবপাচারের পুরো বিষয়টি দেখভাল করতো পিংকি নিজেই। সে নিজেও ছুটে যেতো পার্টির বাড়ি। সব টাকা পয়সা পিংকি তার নিজের অ্যাকাউন্টে নিতো। এতে করে তারা অনেকের কাছ থেকে টাকা লুটে নিয়েছে। বিশ্বনাথের অগ্রণী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকে পিংকির অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
তিনি বলেন, সিলেটের ট্র্যাভেলস ব্যবসায়ী এনামুল হকের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ থাকায় ওই মামলায় এনাম ও রাজ্জাককে আসামি করা হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু আমরা নই, পিংকি ও তার পরিবারের কাছে অনেক মানুষ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। বানিয়াচংয়ের সোহেল রানা নামের এক ব্যক্তির দায়ের করা মামলার আসামি পিংকি। কিশোরগঞ্জের বুলবুল নামের এক যুবকের মাধ্যমে সোহেলের পরিচয় হয়েছিলো পিংকির সঙ্গে। এরপর পিংকি তাদের তিনজনকে লিবিয়া হয়ে ইতালি পাঠানোর নামে প্রথমে ১৬ লাখ এবং পরে আরো ১০ লাখ টাকা নেয়। সোহেল রানা নিজেই ছিলেন ইতালির যাত্রী। ভূমধ্যসাগর ট্র্যাজেডির ঘটনায় তিনি বেঁচে গিয়ে বাড়ি ফিরেন। আর ফিরে এসেই পিংকির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। এখনো পলাতক পিংকির পিতা রফিক আহমদ রফিক। সে কোথায় আছে কেউ জানে না। তবে পিংকির কাছ থেকে রফিকের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
মানবজমিন