প্রবাসীদের সাথে প্রতিনিয়ত বাড়ছে অনলাইন প্রতারণা
মোস্তাক আলী বেগম
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৫১:৫৯,অপরাহ্ন ২৭ জানুয়ারি ২০২৪ইমু, ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্বে উপকারিতার পাশাপাশি রয়েছে হাজারও অপকারিতা। যাকে কখনো দেখেননি সেও হঠাৎ কাছের বন্ধু বনে যায়। একটা সময় আপনার গোপন কথাও জেনে যায় সে। অনেক সময় ওই বন্ধুই আপনাকে মানসিকভাবে বিপদে ফেলতে পারে। ছবি কিংবা ভিডিওর মাধ্যমেও আপনাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিতে পারে। অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা থেকে শুরু করে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক কিছুই করতে পারে সেই অদেখা বন্ধুটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিঙ্গাপুর প্রবাসী তার জীবনে ঘটে যাওয়া এমন একটি ঘটনা এ প্রতিবেদককে জানান।
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি এক মেয়ে আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। মেয়েটির প্রোফাইল ঘেঁটে দেখলাম, সে রূপবতী। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফেসবুকে অ্যাড করি। কিছুদিন পর শুরু হয় আমাদের চ্যাট। হঠাৎ একদিন সে বলল, ফোনটা ভালো না, একটা আইফোন পাঠাও। আমি বললাম, আমার কাছে এখন টাকা নেই। এরপর মেয়েটি নানা কৌশল নিতে থাকে। আমাকে স্ক্রিনশর্টের ভয় দেখাতে শুরু করে। পরে তাকে ব্লক করি’।
দেশ ছেড়ে প্রবাসে অবস্থানরত প্রবাসীদের ফাঁদে ফেলা খুবই সহজ। সহজ সরল প্রবাসীদের ফাঁদে ফেলে অ্যাপভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম ইমোতে চলে অন্তরঙ্গ ভিডিও চ্যাট ও কথাবার্তা। অনেক সময় প্রবাসীরা টাকা দিতে অনীহা প্রকাশ করলে নানাভাবে হুমকি দেয়া হয়। ভিডিও চ্যাটের স্ক্রিনশর্ট ও ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করার ভয়ভীতি দেখানো হয়। এ রকম ফাঁদে পড়ে তাদের টাকা দিতে বাধ্য হয় সহজ সরল প্রবাসীরা।
ইদানিং প্রতারকদের প্রধান টার্গেট প্রবাসীরা। এই চক্র সংঘবদ্ধভাবে প্রবাসীদের সঙ্গে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রবাসী নামে বিভিন্ন ফেসবুক পেজ, গ্রুপ খুলে প্রবাসীদের অ্যাড করে। সেসব পেজ কিংবা গ্রুপে কিছু মেয়েকে লাইভে আসার জন্য ঘণ্টা চুক্তি করে।
রহিম (ছদ্মনাম) নামে এক প্রবাসী জানান, একটা অপরিচিত নম্বর থেকে মাঝে মাঝে আমার ফোনে এসএমএস আসতো। প্রায় সময় মিসকল আসতো। একদিন আমি ফোন ব্যাক করে নারী কণ্ঠ শুনতে পেলাম। এরপর তার সঙ্গে আমার ভাব জমে যায়। ফেসবুক আইডি দেই। ফেসবুকেও তার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছে। বিভিন্ন সময় সে আমার কাছে উপহার দাবি করে। আমিও দিয়েছি। অনেক অন্তরঙ্গ কথাও হয়েছে তার সঙ্গে। আমাকে সেই অন্তরঙ্গ কথার স্ক্রিনশর্ট পাঠিয়ে নানা কিছু চাওয়া শুরু করল। মেয়েটি একদিন মোটা অংকের অর্থ দাবি করে। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দিতো। মেয়েটির পেছনে আমার অনেক টাকা খরচ হয়েছে। হঠাৎ একদিন দেখি তার ফোনে কল যায় না; ফেসবুকে আমাকে ব্লক করেছে।
কাউকে ঠকিয়ে নিজে লাভবান হওয়ার নামই প্রতারণা। বাংলাদেশে পথে-ঘাটে প্রকাশ্য দিবালোকে চলে এ প্রতারণা। মাঝে মধ্যেই শুনি অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে সব খোয়ালেন পথচারী। দেশ ডিজিটাল হওয়ার পাশাপাশি বেড়েছে অনলাইন প্রতারণা। প্রতারকরা মানুষকে ঠকাতে নতুন নতুন ফন্দি ফিকির আটছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক ঘণ্টা লাইভে থাকার জন্য ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত দেয়া হয়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রুপ চ্যাটিং চালাতে মেয়েদের ভাড়া নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে তারা গ্রুপ লাইভ করে। পাশাপাশি চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ফোন নম্বর সংগ্রহ করে। তাদের প্রধান টার্গেট প্রবাসী বাংলাদেশি।
এছাড়া অনেক সময় অনলাইনেও অফার দেয়া হয়। এক ঘণ্টা ভিডিও কলে অন্তরঙ্গ চ্যাট করলে বিনিময়ে ২ হাজার টাকা দেয়া হবে। প্রবাসীরা একাকি জীবনযাপন করে; নিঃসঙ্গতা দূর করতে এসব ফাঁদে পা দেয় তারা।
সিঙ্গাপুরের মতো দেশেও প্রতিনিয়ত অভিবাসী ও স্থানীয়রা এ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। সিঙ্গাপুরের জাতীয় দৈনিক স্ট্রেইট টাইমস এর মতে, ২০১৭ সালের তুলনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছদ্মবেশী প্রতারকদের দৌরাত্ম্য ৯ গুণ বেড়েছে। ২০১৭ সালে ভুক্তভোগী ছিল ৭১ জন। ২০১৯ সালের প্রথম ১১ মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭২ জনে।
২০১৭ সালে ছদ্মবেশে প্রতারণা-সংক্রান্ত ১৮৮টি অভিযোগ জমা পড়ে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরে ৪০১টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই সময় অর্থ-সংক্রান্ত প্রতারণা ১ কোটি ২৮ লাখ থেকে ১ কোটি ৮৮ লাখ ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ তথ্য শুধু প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতেই। অনেকেই প্রতারিত হন কিন্তু আত্মমর্যাদার ভয়ে কারও সঙ্গে শেয়ার করেন না। এমনকি থানায় অভিযোগ পর্যন্তও করেন না।
সিঙ্গাপুরে ২০১৯ সালে অর্থ-সংক্রান্ত প্রতারণা বেড়েছে ৪৩ গুণ। ১৬৮ হাজার ডলার থেকে ৭ কোটি ২ লাখ ডলারে উন্নীত হয়েছে। গত ৬ জানুয়ারি দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী শানমুগাম সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য দেন।
২০১৯ সালে তুলনামূলকভাবে তরুণ বয়সীদের টার্গেট করা হয়। যাদের বয়স ৩০ থেকে ৪০ এর মধ্যে। প্রতারকরা এতই স্মার্ট যে, তারা সহজ সরল অভিবাসী ও স্থানীয়দের টার্গেট করে তাদের প্রতারণা চালিয়ে যায়। এ প্রতারকদের হাত থেকে রক্ষা পেতে স্থানীয় প্রশাসন বিভিন্ন অভিযান চালায়। তার পরও এ প্রতারণা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
অনলাইনে একটি অসচেতনতাই আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই আসুন নিরাপদ অনলাইন ব্যবহার করে প্রতারণা থেকে নিজেকে এবং পরিচিতদের রক্ষা করি।