আমাদের শিকদার মেডিকেল কলেজ
বিশ্ব বাংলা ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১:২৪:০১,অপরাহ্ন ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০০২ সালের কথা। তখন আমি ছিলাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। আমাদের মেডিকেল কলেজের ছাদটা ছিল খুব সুন্দর। ছাদটা ছিল রেলিং বিহীন। আমরা বিকেলে দলবেঁধে ছাদে উঠতাম। তখন মেডিকেল কলেজের চারি পাশে এতো লোকালয়, দোকানপাট ছিলনা। একপাশে ছিল ইতিহাসের সাক্ষী বিশাল বধ্যভূমি। এক পাশে বুড়িগঙ্গা নদী আর এক পাশে রাস্তা-ঘাট, কলেজ ক্যাম্পাসের পেছনের দিকে নৌকা চলতো। ছাদের উপর থেকে সেই দৃশ্যগুলো বিকেল বেলার দিকে অদ্ভুত সুন্দর লাগতো, তা লিখে বোঝানোর নয়।
সূর্য ডুবে যাওয়া পর্যন্ত আমরা ছাদে থাকতাম। আমি পড়তাম মহিলা মেডিকেল কালেজে। দল বেধেঁ কয়েকজন মিলে চায়ের মগ আর বিস্কুটের কৌটা নিয়ে ছাদে বসে থাকতাম।
বধ্যভূমির পেছনে পাল তোলা নৌকা চলতো। সূর্যের আলোতে সেই দৃশ্যগুলো দেখে আমাদের মনে হতো যেন সমুদ্র সৈকতে বসে আছি। বুক ভরে নেয়া যেত সবুজ নিঃশ্বাস। আমাদের মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা জয়নুল হক শিকদার স্যার গাছ খুব পছন্দ করতেন। আমাদের ক্যাম্পাসটি সবুজে ঘেরা। বিভিন্ন ধরনের গাছ রয়েছে আমাদের ক্যাম্পাসে। কলেজের প্রতিষ্ঠাতাকে আমরা বলতাম শিকদার আঙ্কেল।
তিনি শখের বশে ক্যাম্পাসে লাগিয়েছিলেন বহু প্রজাতির গাছ। তখন আমাদের মনে হতো, আমরা বাস করি সবুজে ঘেরা একটি দ্বীপে। সন্ধ্যা হলেই আমরা ছাদ থেকে নেমে নিজেদের রুমে ফিরে যেতাম। হোস্টেলের বেলকোনি দিয়েও দেখা যেত খোলা আকাশ। আমরা পড়ার টেবিলে বসেই দেখতে পেতাম গোধূলীর লালচে আকাশ দিয়ে ঝাঁকঝাঁক পাখি দলবেধে নীড়ে ফিরছে।
সন্ধ্যা হবার সাথে সাথে প্রতিটি রুমে লাইট জ¦লে উঠতো। কেউ পড়তো, কেউ গল্প করতো, কেউ হেডফোন দিয়ে গান শুনতো, এই ছিল আমাদের সন্ধ্যা বেলার দৃশ্য। দল বেঁধে কঙ্কাল আর মেডিকেলের মোটা মোটা বই এর মাঝে হারিয়ে যেতো সিনিয়র আপুরা পরীক্ষার আগে। লেখাপড়া করতো সারা রাত জেগে। শুরুর দিকে হতাশ হয়ে ভাবতাম এ কোন জায়গায় আসলাম আমরা এতো লেখাপড়া! চিকিৎসক হবার স্বপ্ন দেখতাম ছোট বেলা থেকেই কিন্তু মা ভাই বোনকে রাজশাহীতে রেখে হঠাৎ হোস্টেল জীবনের মাঝে হয়ে যেত খুব বেশি মন খারাপ।
সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ক্লাস হতো। রুমে ফিরে খাবার খেয়ে ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়তাম। মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতাম “মা যেন বলছে সোনা কতোদিন তোমাকে দেখিনা, তুমি মন দিয়ে লেখাপড়া করো।”
ক্লান্ত দেহটা পড়ে থাকতো বিছানায় আর মনটা চলে যেত রাজশাহীতে আমার আত্মীয়-স্বাজনের কাছে। নতুন অভিজ্ঞতা, বিচিত্র সব পরিস্থিতি আর বারো রকমের মানুষের বসতি ছিল সেই হোস্টেলে।
মানুষ যে কতো স্বার্থপর আর উদ্ভট হতে পারে তা হোস্টেলে না থাকলে বোঝা যায়না। কিছু নিবেদিত প্রাণ ভালো মানুষের দেখা পেয়েছিলাম আমার হোস্টেল জীবনে। যারা আজোও জড়িয়ে আছে আমার জীবনের সাথে। যেদিন ছাদে যেতে পারতাম না সেদিন আমরা দলবেধে রুমে চা খেতাম। চা ছাড়া আমরা একধাপ চলতে পারতাম না।
চা খেতে খেতে দল বেধেঁ রুমের সবাই মিলে গাইতাম সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের বিখ্যাত সেই গান “আমিতো মরে যাবো, চলে যাবো, রেখে যাবো স্মৃতি এই শিকদার মেডিকেল কালেজে….।” সেই সময় এরশাদ শিকদার নামে বিখ্যাত এক সন্ত্রাসী ছিল।
আমাদের সময়ে কলেজের ২য় তলায় মহিলা হোস্টেল আর ১ম তলায় ছিল ক্লাসরুম। ২য় তলায় ৩টা কুুকুর সারাদিন আর রাত পাহাড়া দিত। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত না হয়েও মনে হতো যেন হোস্টেলের সবকিছু বোঝে। বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। মেয়েদের দেখে পাশে এসে কিছুক্ষণ ঘুরাফেরা করে আবার চলে যেত। কিন্তু ছেলেদের দেখলেই করতো চিৎকার। মাঝে মাঝে হোস্টেল সুপার উন্নতি আপা কুকুরগুলোকে বকা দিতেন।
একদিন রাতে আমাদের এক বান্ধবী ফুলপ্যান্ট, শার্ট পরে বাইরে বের হলো, আর সাথে সাথেই শুরু হলো কুকুরের তাড়া। কুকুরের দৃষ্টিভ্রম হয়েছিল। ভেবেছিলো সেটা বোধহয় কোন পুরুষ। কুকুরগুলো সারারাত জেগে থাকতো। বুড়ীগঙ্গার তীর ঘেষে আমাদের কলেজ। কলেজের ডান পাশে রয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বধ্যভূমি। রায়ের বাজারের এই বধ্যভূমি ৭১ এর যুদ্ধে এদেশের মানুষকে তাদের অম্লান আত্মত্যাগের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই নির্বাক কালো স্তম্ভটা যেন হাজারো কথা বলে যায় আমাদের কানে “শোন, তোমরা স্বাধীন দেশের সন্তান, তোমরা আমাদের রক্তের বিনিময়ে এই কলেজ পেয়েছো। তোমরা আমাদের রক্তের মূল্য দিও।
রাত্রে বেলা হেস্টেলের রেলিং এ দাঁড়াতাম। মনটা খুব খারাপ হলে আকাশের তারাগুলোকে দেখতাম। সাদা আকাশের মাঝে হাল্কা মেঘের আনাগোনা আর তারই মাঝে উজ্জ্বল হয়ে যেত জোৎস্না কিরণ। সাদার মেঘের সাথে চাঁদটাও যেন ভেসে চলতো দূরদিগন্তপানে। রূপালী আভা মনের বিষন্নতা দূর করতো। নদীর মিষ্টি বাতাস হোস্টেলের রেলিং ঘেষে যেত, কি যে ভালো লাগতো! মনে হতো প্রকৃতি তার রেশম কোমল হাত দিয়ে আমার মুখে অপার স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। দূরে গাবতলী বাস টার্মিনালের লাল নীল সবুজ হলুদ লাইটগুলো জ্বলতো। দূর আকাশের তারার মতোই লাইটগুলো ঝিকিমিকি করতো। হারিয়ে যেত মনটা পুরনো স্মৃতিতে। উদাস হয়ে যেতাম আমি। আমাদের হোস্টেল সুপারের নাম ছিল “উন্নতি”। উন্নতি নামটা আমি আজ পর্যন্ত আর কারো নাম হিসেবে শুনিনি।
কলেজের প্রতিষ্ঠাতা শিকদার স্যারের কিছু অ্যাপার্টমেন্ট ছিল আমাদের মেডিকেল কলেজের পিছনে। সেই এপার্টমেন্টের ছাদে উঠলে মতো হতো চারিদিকে পানি আর মাঝে কলেজ। আমরা যেন সমুদ্র সৈকতে থাকি। বুড়ীগঙ্গার এক ধারে উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর অন্য ধারে ছিন্নমূল মানুষের বসতি। হোস্টেলের ছাদে বসে অনুভব করা যেতো দুইধারের জনবসতির মাঝে বিস্তর ব্যবধান।
হসপিটালের এক পাশে চলতো নবজাতকের জন্ম, আবার আরেক পাশে ভীষণ গুরুতর রোগীদেরকে মরতেও দেখা যেত। এক পাশে মিষ্টির বাক্স আরেক পাশে কফিনের বাক্স। এটাই বাস্তবতা। আবার অনেকেই হাসি মাখা মুখে সুস্থ হবার পর ফিরতো বাসায়। আমাদের ক্যাম্পাসের একপাশে ছিল কোরালার সিষ্টারদের বিল্ডিং। তাদের উচ্চতা, ভাষা, চেহারা প্রমাণ দিতো যে, তারা আমাদের সংস্কৃতির মানুষ নয়। তারা ভিন দেশী মানুষ। আমি যখন মেডিকেল কলেজের ফাস্ট ইয়ারে পড়ি, তখন মেডিকেল কলেজে একদল কেরালা সিস্টার ছিল। তারা ছিল ইন্ডিয়ার কেরালা প্রদেশের। বাংলাদেশী মেয়েদের থেকে তুলনামূলকভাবে লম্বা তারা।
আমাদের ক্যাম্পাসের মধ্যে ছিল ভীষণ সুন্দর একটি মসজিদ। মসজিদের দুই তলায় ছিল মেয়েদের নামাযের ব্যবস্থা। আরেক পাশে ছিল মাদ্রাসা, গরুর খামার, ন্যাশনাল ব্যাংক, আনসার ও সিকিউরিটি বাহিনীর থাকার জায়গা, ডেন্টাল কলেজ, নার্সিং কলেজ, ছোটদের জন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। রাজধানী ঢাকার বুকে বিশাল, বিস্তৃত সবুজে ঘেরা ছিল আমাদের মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাস।
একপাশে মেডিকেল কলেজ, একপাশে বিশাল হসপিটাল। হাসপাতালের জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে দেখতাম বুড়িগঙ্গার পানি সূর্যের আলোতে চিকচিক করছে। অদ্ভুত সুন্দর সেই দৃশ্য লিখে বোঝানোর শক্তি আমার লেখনীতে নেই।
বুড়ীগঙ্গার তীর ঘেষে ছিল আমাদের ক্যাম্পাস। চেখে জুড়ানো দৃশ্যের জন্য প্রায়ই সিনেমার নায়ক নায়িকাদের আমাদের ক্যাম্পাসে শুটিং করতে দেখা যেত। বিভিন্ন প্রোডাকশন হাউজ আমাদের ক্যাম্পাসকে শুটিং স্পট হিসেবে ব্যবহার করতো।
আমাদের শিকদার আন্টি (শিকদার আঙ্কেলের স্ত্রী) খুব শখ করে জনবল নিয়োগ করে সব্জি চাষ করতেন। ক্যাম্পাসের এক পাশে ক্ষেতের মধ্যে ফরমালিক ছাড়া টাটকা ফুলকপি, বাধাকপি, লালশাক, পালংশাক দেখে মনে হতো যেন সব্জি নয়, ক্ষেতের মধ্যে শোপিস।
আমরা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা স্যারের স্ত্রীকে বলতাম আন্টি। মাঝে মাঝে সবাই মিলে বলতাম, “যদি আল্লাহ্র বেহেশত বিক্রি হতো, তাহলে শিকদার আঙ্কেল সেই বেহেশত কিনে ফেলতেন।” তিনি ছিলেন ভীষণ সৌখিন মানুষ। শুক্রবারে ক্যাম্পাসের মসজিদে নামায শেষে, অগণিত অসহায় মানুষকে দান করতেন। আমাদের মসজিদে দূর দুরান্ত থেকে অনেকেই নামায পড়তে আসতো।
অদ্ভুত সুন্দর এই ক্যাম্পাসে থেকেও বিষন্ন হয়ে যেতাম আমার মা, ভাই বোনের কথা ভেবে। তখন তারা থাকতো রাজশাহীতে। আমার মনটা তাদের জন্য ছটফট করতো। শুধু মনকে এই বলে স্বান্তনা দিতাম যে, “আমাকে সামনে যেতে হবে, বড় ডাক্তার হতে হবে, আমার মা বাবা আমাদের জন্য সীমাহীন বিসর্জন দিয়েছে, তাদের স্বপ্ন পূর্ণ করতেই হবে।”
সুখ-দুঃখ-ব্যথা নিয়েই ছিল আমাদের এই শিকদার মেডিকেল কলেজ। আমার পেশা জীবনের প্রথম ধাপ। নতুন অভিজ্ঞাতা আর নতুন পথ চলার স্থান ছিল সেটি। ভালো লাগুক বা নাই বা লাগুক ঐ বুড়ীগঙ্গার বহমান নদীর মতো পূর্ব পরিচিত মানুষদের ছেড়ে আমাকে যেতে হবে আরো দূরে………. আরো দূরে। সারা জীবন এই প্রতীজ্ঞা করেছি। আজ বিখ্যাত কবি রবার্ট ফ্রস্টের ভাষায় আমিও বলতে চাই…..
“And miles to go before I sleep
And miles to go before I sleep.”
ডাঃ ফারহানা মোবিন
এমবিবিএস, এমপিএইচ (এপিডেমিওলজি), সি- কার্ড, সিসিডি (বারডেম হসপিটাল) , পিজিটি (গাইনী এন্ড অবসঃ) ।